ওমরাহ পালনে যাওয়ার সময় কোন জিনিসগুলো সাথে রাখবেন
ওমরাহ ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হজের মতো এটি নির্দিষ্ট সময়ে নয়; বরং বছরের যে কোনো সময়ে পালিত
হয়। মুসলমানদের জন্য ওমরাহ আল্লাহর নৈকট্য লাভ, আত্মার পরিশুদ্ধি এবং গুনাহ মোচনের এক বিশেষ সুযোগ। প্রতিবছর
বাংলাদেশ থেকে বহু ধর্মপ্রাণ মুসলিম ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে যান, কিন্তু অনেকেই জানেন না সাথে কী কী
নেওয়া উচিত।
এই লেখায় আমরা ওমরাহ পালনে যাওয়ার সময়
কোন জিনিসগুলো সাথে রাখবেন এবং কোন জিনিসগুলো সাথে রাখবেন না তার একটি
পূর্ণাঙ্গ তালিকা উপস্থাপন করছি
।
ওমরাহ পালনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পূর্ণাঙ্গ তালিকা
ইসলামী শরী‘আতের পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বছরের যে কোনো সময় মসজিদুল হারামে গমন করে নির্দিষ্ট কিছু কর্মকাণ্ড
সম্পাদন করাকে ওমরাহ বলা হয়। প্রথমবার ওমরাহে যাচ্ছন বলেই চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই; ওমরাহর সঠিক প্রস্তুতি নিলে
আপনি নিশ্চিন্তে ইবাদত করতে পারবেন। বাংলাদেশ থেকে ওমরাহ করতে যাওয়ার সময় কি কি জিনিস অবশ্যই সাথে রাখতে হবে তার
একটি তালিকা দেওয়া হল।
১. প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
ওমরাহ যাত্রার ক্ষেত্রে সবার আগে নিজের পরিচয় ও ভ্রমণের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো প্রস্তুত রাখতে হবে। পাসপোর্ট,
ভিসা ও অন্যান্য কাগজপত্র ঠিকঠাক না থাকলে যাত্রার শুরুতেই সমস্যায় পড়বেন। নিচে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টগুলোর তালিকা
দেওয়া হলো:
পাসপোর্ট: বিদেশ যাত্রার প্রথম শর্তই হলো বৈধ ভিসাসহ মেয়াদউত্তীর্ণ না হওয়া পাসপোর্ট প্রস্তুত রাখা।
ভিসা ইলেকট্রনিক (e-visa) হলে সেটির প্রিন্ট কপি সঙ্গে
রাখুন।
পাসপোর্ট ফটোকপি: পাসপোর্টের মূল কপি যত্ন করে রাখার পাশাপাশি অতিরিক্ত ফটোকপি সাথে নিতে পারেন, যাতে
আসল পাসপোর্ট হারিয়ে গেলেও তথ্যপ্রমাণ থাকে।
পাসপোর্ট সাইজ ছবি:ভিসা প্রসেসিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন
কাজে প্রয়োজনের জন্য কমপক্ষে ৮–১০ কপি
পাসপোর্ট সাইজ রঙিন ছবি সঙ্গে রাখুন।
বিমান টিকিট ও বুকিং তথ্য: যাত্রার বিমানের টিকিট ও সময়সূচী সম্পর্কিত কাগজপত্র প্রিন্ট করে রাখুন।
যদি নিজে হোটেল বুকিং করে থাকেন, হোটেল বুকিংয়ের নিশ্চিতকরণ রসিদ সাথে
রাখুন।
অন্যান্য দরকারি কাগজপত্র: উমরাহ পেমেন্টের রসিদ (এজেন্সিকে অগ্রিম দিয়ে থাকলে) এবং পরিচয়পত্রের
ফটোকপি রাখুন।
মোবাইল নম্বর: নিজের ও পরিবারের জরুরি যোগাযোগ নম্বরসমূহ একটি কাগজে লিখে বা কার্ডে প্রিন্ট করে
সঙ্গে রাখুন।
পাউচ বা গলায় ঝোলানো ব্যাগ: টাকা, পাসপোর্ট, টিকেট, কার্ড ইত্যাদি সর্বদা নিজের কাছে নিরাপদে রাখতে
একটি বিশেষ কোমর পাউচ বা গলায় ঝোলানো ব্যাগ ব্যবহার করুন।
কোভিড-১৯ টিকা সনদ: সৌদি সরকারের নিয়ম অনুযায়ী কোভিডের পূর্ণ ডোজ টিকা গ্রহণের সার্টিফিকেট সাথে রাখা
বাধ্যতামূলক।
২. আর্থিক প্রস্তুতি
ওমরাহ যাত্রায় পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ সঙ্গে রাখা গুরুত্বপূর্ণ, তবে খুব বেশি নগদ অর্থ না নিয়ে সুরক্ষিত উপায়ে
অর্থ ব্যবস্থাপনা করাই উত্তম। আর্থিক দিক বিবেচনায় নিচের বিষয়গুলো খেয়াল রাখুন:
পর্যাপ্ত রিয়াল: সৌদি পৌছেই যেন তাৎক্ষণিক খরচ মেটানো যায়, তাই হাতে কিছু সৌদি রিয়াল রাখুন। আনুমানিক
৪০০ থেকে ৫০০ সৌদি রিয়াল সাথে রাখা ভালো।
ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড: অতিরিক্ত খরচের প্রয়োজন পড়তে পারে ভেবে আন্তর্জাতিক ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড সঙ্গে
রাখুন, যা দিয়ে সেখানে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে পারবেন।
বাংলাদেশী টাকা: বিমানে উঠার আগে বা নামার পর কিছু কাজে বাংলাদেশী টাকা প্রয়োজন হতে পারে। তাই কিছু
বাংলাদেশী টাকা সঙ্গে রাখুন।
মূল্যবান জিনিস না নেওয়া: সৌদি হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ওমরাহযাত্রীরা অতিরিক্ত
মূল্যবান ধাতু-গহনা না নিয়ে যাওয়াই শ্রেয় এবং সর্বোচ্চ ৬০ হাজার সৌদি রিয়াল (১৬,০০০ ডলার) এর বেশি
নগদ অর্থ
সঙ্গে বহন করা নিষিদ্ধ।
৩. লাগেজ ও ব্যাগ ব্যবস্থাপনা
সঠিক ধরণের ব্যাগ ও লাগেজ নির্বাচনের ওপর আপনার যাত্রা কতটা আরামদায়ক হবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে। লাগেজ ও ব্যাগ
সম্পর্কিত কিছু পরামর্শ:
প্রধান লাগেজ/স্যুটকেস: একটি মজবুত চাকা ওয়ালা মাঝারি বা বড় আকারের লাগেজ ব্যবহার করুন যাতে সব
দরকারি জিনিস ধরবে এবং বহন করতেও সহজ হবে।
লাগেজ অতিরিক্ত ভারী করবেন না: সাধারণত ৮-১০ কেজি ওজনের মধ্যে রাখাই উত্তম। এয়ারলাইনের নিয়ম অনুযায়ী
শ্রেণিভেদে প্রায় ২০-৩০ কেজির মধ্যে ব্যাগেজ সীমা থাকে।
হাতব্যাগ ও ব্যাকপ্যাক: প্রধান লাগেজের বাইরে একটি ছোট হাতব্যাগ বা ব্যাকপ্যাক রাখুন যা কাঁধে নিয়ে
সহজে ঘোরা যায়। এই ব্যাগে শুধু প্রয়োজনীয় জিনিস রাখুন।
জুতা/স্যান্ডেল রাখার ব্যাগ: মসজিদে প্রবেশের সময় জুতা রেখে ঢুকতে হয়, তাই জুতা রাখার জন্য ব্যাগ
সাথে রাখুন।
লাগেজ ট্যাগ ও তালা: নিজের প্রতিটি ব্যাগে ইংরেজিতে নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর ও পাসপোর্ট নম্বর লিখে
লাগিয়ে রাখুন।
অতিরিক্ত ব্যাগ ও পলিথিন: কিছু পলিথিন/জিপলক ব্যাগ নিয়ে যেতে পারেন। ময়লা কাপড়, ভেজা কাপড় বা ছোটখাট
জিনিস প্যাক করার জন্য এগুলো কাজে আসবে।
৪. পোশাক ও ইহরামের প্রস্তুতি
ওমরাহ পালনের জন্য উপযুক্ত ও আরামদায়ক পোশাক নির্বাচন করতে হবে। পুরুষ ও মহিলার পোশাকের ধরন ভিন্ন, বিশেষ করে
ইহরাম পালনের সময় পোশাকবিধি আলাদা থাকে। নিচে পোশাকসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ
দিকগুলো তুলে ধরা হলো:
পুরুষদের জন্য
ইহরামের জন্য দুই সেট সাদা কাপড়।
ইহরামের কাপড় বাধার জন্য কোমর বেল্ট।
মাথা মুড়ানোর জন্য ১/২টি রেজার অথবা ব্লেড।
উপযুক্ত ও আরামদায়ক: প্যান্ট, শার্ট, ট্রাউজার, লুঙ্গি, টি-শার্ট, আন্ডারওয়্যার, পাঞ্জাবি, স্যান্ডেল, মোজা,
জুতা ইত্যাদি।
মহিলাদের জন্য
আরামদায়ক সালওয়ার-কামিজ, স্কার্ফ, হিজাব।
পুরো যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত কাপড়।
মহিলাদের ন্যাপকিন, সেফটি পিন, কাঁচি, টিস্যু পেপার, স্যান্ডেল, মোজা ও জুতা ইত্যাদি।
৫. ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সামগ্রী
নিজের দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলে ওমরাহ যাত্রায় ভোগান্তি এড়ানো যায়। ব্যক্তিগত যত্নের নিম্নলিখিত
জিনিসগুলো নিতে ভুলবেন না:
টুথব্রাশ, পেস্ট ও মিসওয়াক।
সাবান ও শ্যাম্পু।
লোশন ও পেট্রোলিয়াম জেলি।
নেইলকাটার ও ছোট কাঁচি।
সানগ্লাস ও ছাতা।
টুপি বা ক্যাপ।
মাস্ক, আই মাস্ক (ঐচ্ছিক)।
মার্কার পেন, কলম ও ছোট নোটবুক।
স্মার্ট টিপ: ইহরাম অবস্থায় সুগন্ধিযুক্ত টুথপেস্ট, সাবান-শ্যাম্পু ব্যবহার করা নিষেধ। বাজারে বিশেষভাবে
হজ/ওমরাহ জন্য অ্যাসেন্স-ফ্রি সাবান-শ্যাম্পু পাওয়া যায়, সেগুলো নিতে পারেন। ধাতব বস্তুগুলো যেন হ্যান্ডব্যাগে
না থাকে, কারণ বিমানবন্দরে এগুলো হ্যান্ডব্যাগে পাওয়া গেলে ফেলে দিতে পারে।
৬. ওষুধপত্র ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা
যাত্রাপথে এবং বিদেশের আবহাওয়ায় হালকা অসুস্থতা যে কারো হতে পারে, তাই প্রয়োজনীয় ওষুধ-পত্র সাথে রাখা অত্যন্ত
জরুরী। নিচের ওষুধপত্রগুলো সঙ্গে নিন:
সাধারণ ওষুধপত্র (প্যারাসিটামল, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ, স্যালাইন প্যাকেট, ইত্যাদি)।
ব্যক্তিগত প্রেসক্রিপশন ওষুধ (উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস)।
আত্মিক ইবাদতের সফরে যাচ্ছেন, তাই এমন কিছু জিনিসও সঙ্গে রাখতে পারেন যা আপনার ইবাদতকে আরও মনোযোগী করতে সহায়ক
হবে:
কুরআন ও দোআর বই: তিলাওয়াতের জন্য একটি ছোট আকারের কুরআন শরীফ সঙ্গে নিতে পারেন। বর্তমানে অনেকে
মোবাইল অ্যাপও ব্যবহার করেন।
প্রয়োজনীয় দোআ ও জিকিরসমূহর বই: একটি ছোট পকেট বুক বা দোয়ার বই নিতে পারেন যাতে সময়ে সময়ে দেখে পড়ে
নিতে পারেন। বিশেষ করে ওমরাহ পালনের নিয়ম ও ওমরাহর প্রয়োজনীয় দো’আ সংবলিত একটি
গাইডবুক রাখলে খুব উপকার হবে।
তসবিহ ও জায়নামাজ: অনেক সময় হারামে অপেক্ষারত অবস্থায় জিকির করার প্রয়োজন হয়, তাই একটি তসবিহ বা
ডিজিটাল তাসবিহ কাউন্টার নিতে পারেন। ওমরাহ তাওয়াফের সময় সাত চক্কর হিসাব রাখতে সহায়ক হবে।
জায়নামাজ: নামাজের জন্য মসজিদে কার্পেট থাকলেও বিশাল ভিড়ে কখনও স্থান মিলতে দেরি হয় – তাই সঙ্গে একটি
ছোট ভাঁজযোগ্য জায়নামাজ রাখুন।
উল্লেখ্য: এই ধর্মীয় উপকরণগুলোর অনেক কিছুই বাধ্যতামূলক নয়।
কি কি জিনিস সাথে রাখবেন না তার তালিকা
ওমরাহ সফরে কিছু জিনিস একেবারেই সাথে নেওয়া যাবে না বা এড়িয়ে চলা উচিত। যেমন:
অ্যালকোহল ও মাদকদ্রব্য
অস্ত্র, ছুরি, আগ্নেয়াস্ত্র বা বিস্ফোরক দ্রব্য
সুগন্ধিযুক্ত প্রসাধনী, সাবান, পারফিউম (ইহরামের সময় নিষিদ্ধ)
অতিরিক্ত নগদ অর্থ (৬০ হাজার সৌদি রিয়ালের বেশি বহন করা নিষেধ)
হলি হজ এন্ড ওমরাহ বাংলাদেশের অন্যতম বিশ্বস্ত হজ ও উমরাহ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, যারা আপনাকে
সঠিক দিকনির্দেশনা ও সহায়তা প্রদান করে। আপনার ইবাদতকে সহজ ও সুন্দর করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।